সহিজল ইসলাম, রাজীবপুর (কুড়িগ্রাম)প্রতিনিধি
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ কালো রাতে পাকবাহিনীরা বঙ্গবন্ধু শেখ মজিবুর রহমানকে গ্রেপ্তার করে পশ্চিম পাকিস্তানে নিয়ে যাওয়ার খবর সর্ব প্রথম রেডিও’তে শুোনেন আব্দুস সোবাহান।পাক হায়েনাদের হাতে বন্দি বঙ্গবন্ধু শেখ মজিবুর রহমানের যেন কোন ক্ষতি না হয়।সেজন্য নামাজ পড়ে আল্লাহর কাছে তিনি ওয়াদা করে বঙ্গবন্ধুর জন্য পুরো এক বছর রোজা রাখার।
পরের দিন থেকে আমি রোজা থাকা শুরু করেন সোবাহান । দিন তারিখ সঠিক মনে নেই তবে বাংলা সনের চৈত্র মাস ছিল।পরের বছর চৈত্র মাস আসলে আমি রোজা থাকা বন্ধ করি। মাঝে দুই ঈদে রোজা থাকা হয়নি। কুড়িগ্রামের রাজীবপুর উপজেলায় বঙ্গবন্ধু প্রেমী সোবাহানের সাথে কথা হলে এভাবেই বর্ণণা জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখমুজিবুর রহমানের প্রতি তার বিরল ভালবাসার স্মৃতি।
আব্দস সোবাহানের বাড়ি কুড়িগ্রাম জেলার রাজীবপুর উপজেলার মোহনগঞ্জ ইউনিয়নের ব্রহ্মপুত্র নদ বিচ্ছিন্ন দুর্গম চরে।
সম্প্রতি বঙ্গবন্ধু প্রেমী ওই সোবাহানের বিষয়ে জানতে সরেজমিনে তার বাড়িতে গিয়ে কথা হয়। রাজীবপুর উপজেলা শহর থেকে প্রায় ৫ কিলোমিটার দূরে মোহনগঞ্জ ইউনিয়নের ব্রহ্মপুত্র নদ বিচ্ছিন্ন বড়বেড় চরে আব্দুস সোবাহানের বাড়ি। মটরসাইকেল যোগে ৫ কিলোমিটার যাওয়ার পর শ্যালো মেশিন চালিত নৌকায় ৩০ মিনিট সময় লাগে। এরপর পায়ে হেঁটে ছোট বালুচর পাড়ি দিলেই সেবাহানের বাড়ি। স্ত্রী জয়গন বেগম মারা গেছেন বছর দুয়েক আগে। ৬ মেয়েকে বিয়ে দিয়েছেন। ২ ছেলের মধ্যে একজন গাজীপুরের কোনাবাড়িতে থাকেন। আরেক ছেলে চরেই বসবাস করেন।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতি তার ভালবাসার বিষয়টি প্রথম জানতে পারি স্থানীয় স্কুল শিক্ষক শহীদুল্লাহ হকের কাছে। তাকে সাথে নিয়েই সোবহানের বাড়িতে যাই এই অনন্য ভালবাসার কথা শুনি তার মুখে।
আব্দুস সোবাহান বাড়িতে কথা হলে তিনি বলতে শুরু করেন তার জীবনের ঘটনাবলী। আমি লেহাপড়া জানি না। বাবার সংসারের কাম করি। যুদ্ধের সময় আমার বয়স ৩০ এর মত। তখন আমি নিয়মিত রেডিও শুনি। ক্ষেতে কাজ করতে গেলেও সঙ্গে রেডিও নিয়ে যাই। রেডিও’তে বঙ্গবন্ধুর ভাষন শুনতাম। তাঁর ভাষন আমার খুব ভালো লাগত। ৬৯’র নির্বাচনে শেখ মজিবুর রহমান বিজয়ী হলেও পাকিস্তানারী ক্ষমতা দেয়নি। দেশের প্রতি, দেশের মানুষের প্রতি বঙ্গবন্ধুর যে ভালোবাসা দেখিয়েছেন তা শুনে আমি উনাকে ভালবেসে ফেলি। দেশের মানুষের অধিকার আদায়ে বঙ্গবন্ধু যে ভাবে সংগ্রাম করেছেন, দেশের মানুষের নির্যাতনের প্রতিবাদ করেছেন। তা শোনার পর আমার ভিতরটা কেমন যেন হয়ে যায়। বঙ্গবন্ধু স্বচক্ষে না দেখেও তার প্রতি আমার ভালোবাস, শ্রদ্ধাবোধ জন্ম নেয় আমার ভিতরে। বঙ্গবন্ধুর প্রতি আমার ভালোবাস আর শ্রদ্ধাবোধ হৃদয়ে গেঁথে গেল যখন পূর্ব পাকিস্তানীদের হাতে বার বার নির্যাতনের শিকার হলো, জেল খাটল বঙ্গবন্ধু। মানুষটা নিজের জন্য না ভেবে দেশ ও দেশের মানুষকে মুক্ত করতে হাজারো নির্যাতন সহ্য করেছেন। বঙ্গবন্ধুর নাম শুনলেই আমার ভিতরটা কেমন যেন হয়ে ওঠে।
আব্দুস সোবাহান আরও বলেন, ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে পাকবাহিনীরা বঙ্গবন্ধু শেখ মজিবুর রহমানকে গ্রেপ্তার করে পশ্চিম পাকিস্তানে নিয়ে যাওয়ার খবর সর্ব প্রথম রেডিও’তে শুনতে পাই। এ খবর শোনার পর আমি আর দাড়িয়ে থাকতে পারছিলাম না। ঘরে গিয়ে শুয়ে পরলাম। যোহরের নামাজ আদায় করে দুই রাকাত নফল নামাজ আদায় করে আল্লাহর কাছে দোয়া করলাম উনার জন্য যাতে তার কোন ক্ষতি না হয়। আল্লাহর কাছে আরও বললাম সুস্থ অবস্থায় তিনি যেন দেশে ফেরে সেজন্য আমি রোজা রাখার নিয়াত করছি আমি পুরো এক বছর রোজা করব। পরের দিন থেকে আমি রোজা রাখা শুরু করি। সঠিক দিন তারিখ মনে নাই তবে বাংলা সনের চৈত্র মাস ছিল।পরের বছর আবার চৈত্র মাস আসলে আমি রোজা থাকা বন্ধ করি। মাঝে দুই ঈদের দুই দিন রোজা থাকা হয়নি।
বঙ্গবন্ধু শেখ মজিবুর রহমান দেশে ফেরার পর আমি এত খুশি হয়েছিলাম যা আমি প্রকাশ করতে পারব না। মনে মনে ভাবছিলাম মহান আল্লাহ আমার কথা শুনেছেন। বঙ্গবন্ধু যখন দেশে ফেরে তখন আমার রোজা এক বছর পূরণ হয়নি। তারপরও আমি রোজা করে বছর পূর্ন করি। কেননা এক বছর রোজা থাকার ওয়াদা করেছিলাম আল্লাহর কাছে। এই দীর্ঘ ১২ মাস রোজা করতে আমার সমস্যাও হয়েছিল অনেক। আমার বউ রোজা থাকতে দিতে চাইত না। এ কারনে অনেক শেষ রাতের সেহরি খাবার থাকত না। সেহরি না খেয়েই আমি রোজা থাকছি। শেষ রাতে না খেয়ে যে কতদিন রোজা ছিলাম তা আমি বলতে পারব না।
দেশে তো তখন মুক্তিযুদ্ধ চলছিল, আপনি যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করেননি কেন এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, আমি তখন কিছুটা অসুস্থ্য ছিলাম। যুদ্ধে না গেলেও আমি মুক্তিবাহিনীদের জন্য আমি অনেক সহযোগিতা করেছি, রান্না করে খাবার নিয়ে দিয়েছি। আমাদের চরে মুক্তিবাহিনীদের ৭টি ক্যাম্প ছিল। তার মধ্যে ৩টি ক্যাম্পে মুক্তিবাহিনীদের নিয়মিত খাবার দিয়েছি আমি। বড়বেড় চরের ইসহাক সরকারের বাড়িতে, সন্নাসীকান্দি কাচারি স্কুলে ও আব্দুল হাই’য়ের বাড়িতে মুক্তিবাহিনীদের ক্যাম্প ছিল। আমি বাড়িতে রান্না করে ওই তিনটি ক্যাম্প খাবার নিয়ে দিয়ে আসতাম। ওই সময়ে আমাদের অবস্থা স্বচ্ছল ছিল। নিজেদের পুকুরের মাছ ধরে মুক্তিবাহিনীদের জন্য রান্না করেছি। দেশ স্বাধীন হওয়ার পরের দিন বাবাকে বলে কইয়ে গোয়ালের একটা গরু জবাই দিয়ে চরের মানুষকে খাইয়েছি। এসময় বঙ্গবন্ধু ও তাঁর পরিবারের জন্য মিলাত মাহফিলের আয়োজন করা হয়েছিল।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগষ্ট বঙ্গবন্ধুকে হত্যার ঘটনা কিভাবে শুনেছিলেন জানতে চাইলে তিনি আরও বলেন, বঙ্গবন্ধু ও তার পরিবারের সদস্যদের হত্যার খবর প্রথমে শুনতে পাই রেডিও’তে। এ খবর শোনার পর আমি অসুস্থ্য হয়ে পরি। দুইদিন বিছানা থেকে উঠতে পারিনি। যে মানুষটা নিজের জন্য না ভেবে, নিজের পরিবারের কথা চিন্তা না করে সারাক্ষন দেশের মানুষের জন্য হাজারো জুলুম নির্যাতন সহ্য করেছেন জেল খেটেছেন। পাকিস্তানে বন্দি থাকার পরও হায়নারা তাঁকে মারতে পারেনি। সেখানে আমার দেশের কিছু মানুষ বঙ্গবন্ধু ও তাঁর পরিবারকে নির্মম ভাবে খুন করল।বঙ্গবন্ধু এবং তার পরিবারকে মেরে ফেলার পর বেশ কয়েক মাস আমার কোন কিছুই ভাল লাগত না মনটা সবসময় খারাপ থাকত। কাজকর্মে মন বসত না।
ব্রহ্মপুত্র নদের করাল গ্রাসে ভাঙ্গনের ফলে জমাজমি, ভিটেমাটি হারিয়ে নিংস্ব হয়েছেন সোবাহান। আগের মতো আর্থিক অবস্থা এখন আর নেই। তারপরও প্রতিবছর ১৫ আগস্ট বাড়িতে ছোট পরিসরে মিলাত মাহফিলের আয়োজন করে বঙ্গবন্ধুর জন্য, তার পরিবারের জন্য এবং বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যার জন্য আল্লাহর দরবারে দোয়া মোনাজাত করে বলে জানান স্থানীয় শিক্ষক শহিদুল হক।
রাজীবপুর উপজেলার দুর্গম ব্রহ্মপুত্র চরাঞ্চলের দক্ষিন বড়বেড় চরের মৃত আফাজ উদ্দিন ব্যাপারির পুত্র আব্দুস সোবাহান বয়স প্রায় ৯০ বছর। পারিবারিক জীবনে সোবাহানের দুই ছেলে ও ৬ মেয়ে। ছেলেমেয়েদের সবাইকে বিয়ে দিয়েছেন। বার বার ব্রহ্মপুত্র নদের ভাঙ্গনের শিকার হয়ে সব কিছু হারিয়ে সোবাহান এখন নিঃস্ব। এক ছেলে থাকেন এলাকায় আরেক ছেলে বাড়ি করেছেন নীলফামারীর ডোমার উপজেলায় নওদাপাড় নামক গ্রামে। দুই ছেলে আর মেয়েদের বাড়িতে জীবন কাটে সোবাহানের।
বড়চরের বাসিন্দা ও সোবানের প্রতিবেশি নুর হোসেন (৬৮) সাথে কথা বলে জানা গেছে , সোবাহান বঙ্গবন্ধুকে বাঁচানোর জন্য ১২ মাস রোজা করেছেন এটা এলাকার প্রায় সবাই আমরা সবাই জানে। মুক্তিযোদ্ধা আবুল কাশেম (৭৪), মমতাজুর রহমান (৭৯) জানান, দেশ স্বাধীন হওয়ার পরের দিন সোবাহানের বাড়িতে চরের সব মানুষকে দাওয়াত খাইয়ে মিলাদ মাহফিলের আয়োজন করে বঙ্গবন্ধুর সুস্থতা কামনা করে দোয়াও করা হয়েছিল। চরের ইউপি মেম্বার নুরুল হক বলেন, ‘আমরাও সোবাহানের ঘটনার গল্প শুনেছি বড়দের কাছ থেকে। ওই চরের মুক্তিযোদ্ধা নুরন্নবী হোসেন বলেন, ‘বঙ্গবন্ধুর জন্য সোবাহান ১২ মাস রোজাই থাকেননি। মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্পে খাবারও দিতেন। আমরা তাকে ভাত খাইতে বললে তিনি ভাত না খেয়ে বলতেন আমি রোজা আছি। বড়বেড় ৭টি মুক্তিবাহিনীদের ক্যাম্প ছিল। আমাদের পশ্চিমেই গাইবান্ধার কামারজানিতে পাকবাহিনীদের অবস্থান ছিল। আমরা কোনো ভাবে তাদের ব্রহ্মপুত্র নদ পার হতে দেইনি।
রাজীবপুর উপজেলা আ’লীগের সাধারণ সম্পাদক শফিউল আলমের সাথে বঙ্গবন্ধু প্রেমী সেবাহানের বিষয়ে কথা হলে তিনি জানান,তার বিষয়টি আমরা সকলেই জানি,দলীয় বিভিন্ন সভা সমাবেশে ও নতুন প্রজন্মের রাজনৈতিক নেতা কর্মী দের কাছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতি তার যে ভালবাসা তা প্রচার ও প্রকাশ করি।