• বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ০৯:৩৫ অপরাহ্ন |
  • English Version
ব্রেকিং নিউজ :

জীবন বনাম জীবিকা

জাকারিয়া জাহাঙ্গীরঃ

গতবছর বাংলাদেশে করোনাভাইরাস সংক্রমণের শুরুর দিকে মাত্র কয়েকদিনের সাধারণ ছুটি ঘোষণার পর থেকে কেটে যাচ্ছে প্রায় দেড়টি বছর। সাধারণ ছুটির মাঝেও আঞ্চলিক লকডাউন, এলাকাভিত্তিক রেডজোন ঘোষণা ও সর্বশেষ চলতি বছরের ১ জুলাই থেকে কঠোর লকডাউনের শিকার সমগ্র বাংলাদেশ। বিশ্বের অধিকাংশ দেশ যেখানে সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে আনতে অনেকটাই সক্ষম হয়েছে, সেখানে বাংলাদেশে মাঝামাঝিতে কিছুটা কমে ফের তা বেড়ে চলায় আতঙ্কের কারণ। সংক্রমণ ঠেকাতে মানুষকে সঙ্গনিরোধ ও ঘরে রাখাসহ কঠোরভাবে স্বাস্থ্যবিধি পালনের বিকল্প নেইÑএটা সত্য। কিন্তু দেশের অধিকাংশ জনগোষ্ঠির দারিদ্রতা সর্বশেষ কোথায় গিয়ে পৌঁছবেÑতা নিয়ে যথেষ্ট সংশয় রয়েছে। ভয়াবহ চাপের মুখে পড়তে হচ্ছে নি¤œআয়ের মানুষকে। করোনার চাইতে অর্থনৈতিক দূর্যোগ সামনে আমাদেরকে ভয়াবহ বিপর্যয়ের মুখে পড়তে হতে পারেÑতা সন্দেহ নেই। করোনা নিয়ন্ত্রণে স্বাস্থ্য বিভাগের তৎপরতা, টিকা আমদানিতে ক‚টনৈতিক সফলতা, খাবার নিশ্চিত করতে ত্রাণ বিতরণের অনেক গল্পই আমরা জানি। সরকারের এত তৎপরতার পরও কেন বেড়ে গেল সংক্রমণ?
সরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত ও এমপিওভূক্ত শিক্ষকÑযাঁরা ঘরে বসে নিয়মিত বেতন-ভাতা পাচ্ছেন, তাঁরা বরাবরই লকডাউন-শাটডাউনের পক্ষে, সরকার তাঁদের বেতন-ভাতা কমিয়ে দিন, দেখুন তাঁদের ‘করোনাভীতি’ থাকে কি-না! একমাসেই তাঁরা আন্দোলনে নেমে পড়বেনÑনিশ্চিত। জীবিকার চাইতে জীবন বড়Ñএসিতে থাকা বড়বাবুরা পাবলিককে এমন কথাই শোনাচ্ছেন। কিন্তু জীবিকা ছাড়া জীবন চলেÑএমন কোনো নজির বা পদ্ধতি কি আছে তাঁদের কাছে? মহামারী কমাতে মানুষকে ঘরে রাখতে লকডাউন দিয়েছে সরকার, কিন্তু সকলের ঘরে খাবার নিশ্চিত করা হয়েছে কি? উল্টো চাল-ডাল, ভোজ্যতেলসহ প্রতিটি নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের বাজারমূল্য বেড়েছে ঘোড়ার মতো লাফিয়ে। সরকার চাইলে ভর্তুকি দিয়ে ও নজরদারি বাড়িয়ে বাজার নিয়ন্ত্রণ করতে পারতো, কিন্তু তা করা হয়নি। লকডাউনের পাশাপাশি দ্রব্যমূল্যের ঊর্দ্ধগতি ‘মরার উপর খাঁড়ার ঘা’। গতবছর হাট-বাজারে প্রশাসন কিছুটা তৎপর থাকলেও এবার দেখা যাচ্ছে না। ম্যাজিস্ট্রেট, পুলিশ, সেনাবাহিনী শুধুমাত্র লকডাউন বাস্তবায়নেই মাঠে কাজ করছে কঠোরভাবে।
গতবছর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ৭২ হাজার ৭৫০ কোটি টাকা করোনাকালীন আর্থিক প্রণোদনা দিয়েছিলেন; তার কতটুকু মাঠপর্যায়ে কাজে লেগেছে, নি¤œআয়ের ও দিনমজুরদের আদৌ এ প্রণোদনায় উপকার হয়েছে কিনাÑতা সরকার খোঁজ নিয়েছে কি? যেসব ত্রাণ বরাদ্দ হয়েছিল সেসব কতটা বিতরণ হয়েছে তার সঠিক খবর জানে কি? দেশে যথেষ্ট খাদ্য মজুদ ও মাথাপিছু আয় বৃদ্ধির সরকারি তথ্য আমরা যা-ই জানি, দেশের প্রান্তিক পর্যায়ের মানুষ সে তুলনায় কতটা উপকারভোগীÑসেটাই বড় প্রশ্ন। বাংলাদেশে শিল্পপতি, ধনাঢ্য ব্যবসায়ী, মিলিয়নিয়ারের সংখ্যা নেহায়েত কম নয়। কিন্তু দেশের সিংহভাগ অর্থ সমাজের মুষ্টিমেয় শ্রেণির হাতে আবদ্ধ থাকায় ধনি-গরিবের বিরাট ফারাক। বিত্তশালীরা যে হারে ক্রমেই ধনী হচ্ছেন, আনুপাতিক হারে গরিবরা সে তুলনায় এগোতে পারছেন না। তাই সমাজে উন্নয়নের সুসম বণ্টন নেই, মানুষে-মানুষে সমতা নেই। দেশের এই ক্লান্তিলগ্নে মানুষকে নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্য দিয়ে সহযোগিতা করবার মতো ধনবানের খুব একটা দেখা নেই। যাঁরা এগিয়ে আসছেন, মোট ধনশালীর একভাগও হবে কিনা সন্দেহ। দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থেকে মাঠপর্যায়ের ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীরা ফুলে-ফেঁপে যে চর্বি বানিয়েছেন, সে তুলনায় তাঁরা কতটা জনগণের পাশে আছে? যাও দেখা যাচ্ছে, শুধুমাত্র মিডিয়া কভারেজ বা ফটোসেশনই গুরুত্বপূর্ণ। দু-তিন টাকার একটা মাস্ক দিতে ১০-১২ জন লাইনে দাঁড়িয়ে ফটোসেশনের ছবি আমরা অনেক দেখেছি। কোনো কোনো এমপি-মন্ত্রীসহ অনেক এলাকার জনপ্রতিনিধিরা সরকারি বরাদ্দকে ‘ব্যক্তিগত উদ্যোগে ত্রাণ বিতরণ’ ব্যানার ব্যবহার করে মিডিয়া কভারেজ পেয়েছেÑকতটা বেহায়া হলে এমনটা সম্ভব! জনপ্রতিনিধিদের বলছি, খাদ্যসামগ্রী বিতরণকালে দয়া করে ফটোসেশন বন্ধ করুন। সামান্য কিছু চাল-ডাল নিতে আসা মানুষকে ছবি তোলার নামে বিব্রত করবেন না। এরা দয়া নিচ্ছেন না। মনে রাখবেন, যাঁদের হাতে-পায়ে ধরে ভোট ভিক্ষা নিয়ে নির্বাচিত হয়েছেন, তাঁদের পাশে দাঁড়ানো আপনার দায়িত্ব-কর্তব্য।
শিল্প-কারখানা খোলা রেখে লকডাউন দেয়া হলো; সেগুলোতে স্বাস্থ্যবিধি মানা হচ্ছে না সঠিকভাবে। সেখানে করোনা নেই নিশ্চয়ই? আচ্ছা, করোনা যদি জায়গা চিনে তাহলে দুর্নীতিবাজ, কর ফাঁকিবাজ, দালাল-বাটপার এদের কাছে পাঠানো যায় না? তাহলে অন্ততঃ গরিবরা বাঁচে ভয় থেকে! গার্মেন্টস মালিকরা বারবার শ্রমিকদের নানা ঝুঁকির মধ্যে ফেলেছে। গতবছর বিজিএমইএ গার্মেন্টস খোলার নোটিশ দিলে হাজার হাজার শ্রমিক শত-শত কিলোমিটার পথ পায়ে হেটে কর্মস্থলে রওনা করেন, পরদিন বন্ধের ঘোষণা দেয়া হয়। আবারও খোলার নোটিশ হয়, যাঁরা সঠিক সময়ে যেতে পারেনি সেসব শ্রমিকদের চাকরিচ্যুত করা হয়। কারখানা মালিকদের এমন কর্মকাÐে এটাই প্রমাণিত হয়, তাঁরা দেশের অর্থনীতির চাকা নয়; নিজেদের ভাগ্যের চাকা সচল রাখতেই মরিয়া।
সরকারের সাফল্যের কথামালা অনেক শুনেছি; কিন্তু গত দেড় বছরে কতজন মানুষ নতুন করে দরিদ্র হয়েছে, কতজন বেসরকারি কর্মজীবী চাকরি হারিয়েছেন, কতজন কোচিং-প্রাইভেট শিক্ষক কর্মহীন হয়েছেÑসেসব পরিসংখ্যান কি আছে সরকারের কাছে? তাঁদের দিন কীভাবে কাটে জানে কি সরকার? কর্মহীন মানুষ এখন দিশেহারা। খাদ্যের যোগান যথেষ্ট নয়। ঘরে বসে থাকলে ক্ষুধার জ্বালা, বাইরে গেলে ভাইরাসÑএই নিয়ে এখন নি¤œ আয়ের মানুষের দুশ্চিন্তা। দৈনিক আয়ের উপর যারা নির্ভরশীল সে সব নি¤œবিত্ত ও নি¤œ মধ্যবিত্ত পরিবারগুলো সবচেয়ে বেশি বিপাকে। পরিবারের সদস্যদের মুখে দু’মুঠো আহার যোগাতে ভাইরাসের ভয় উপেক্ষা করে যারা বাইরে বের হচ্ছেন, তাদের প্রশাসনের সামনে পড়তে হচ্ছে। কোথাও কোথাও শিকার হচ্ছেন পিটুনি কিংবা লাঞ্ছনার। দরিদ্র মানুষের চিন্তা, করোনার আগে কি ক্ষুধায় মরবেন? তাই মানুষকে ঘরে রাখবার জন্য সরকারকে প্রতিটি ঘরে খাদ্যব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে বলবো, লকডাউন বাস্তবায়নে আর্মি-পুলিশ মাঠে দিয়েছেন ভালো কথা; প্রতিটি টহলগাড়িতে খাবারের বস্তাও দিয়ে দিনÑযেন টহলের পাশাপাশি নিতান্তই অসহায় মানুষদের তাৎক্ষণিক সাহায্য দিতে পারে।
লেখক: কবি, সাংবাদিক ও জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত প্রাবন্ধিক।


আপনার মতামত লিখুন :

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।